আজকের আলোচ্য বিষয়: লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর নোয়াখালি অঞ্চলের মানুষের জীবনে অভাব থাকলেও দেখা যায় ভোরবেলায় মক্তবে কচিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠে আমসিপারা পড়ার কোলাহল। পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই, ল্যাংটা ক্ষুধাতুর ছেলেরা সেই কোলাহলের অংশীদার। তারা জীবনকে যতটা ভালোবাসে মৃত্যুকে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ভয় পায়। তাই লেখক কিছুটা ব্যাঙ্গাত্বক ভাষায় বলেছেন, এটি হয়তো খোদাতালার বিশেষ একটি অঞ্চল যেখানে মানুষ এতটা ধর্ম সংলগ্ন।
লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর (PDF)
১. খালেক ব্যাপারে তার স্ত্রীকে তালাক দেয় কেন?
উত্তর: আওয়ালপুরের পীরের প্রতি প্রতিহিংসায় মসজিদ খালেক বেপারীকে প্ররোচিত করা এসে তার স্ত্রীকে তালাক দেয়। খালেক বেপারি একজন ব্যক্তিত্বহীন মানুষ। তার নিজস্ব কোন চিন্তা চেতনা নেই। সে ও মজিদ আওয়ালপুরের আগত পীরের বিরুদ্ধে একাট্টা। অথচ এই বেপারী স্ত্রী আমেনা বিবি অনুরোধে সেই পীরের কাছ থেকে পানি পড়া আনতে পাঠায়। ধলা মিয়া সেকথা মজিদকে বলে দেয়। তখন মজিদ ক্ষেপে গিয়ে খালেক বেপারীকে পরামর্শ দেয় যেন সেই বউকে তালাক দেয়। এ কারণেই খালেক বেপারী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়।
২. মজিদ নাটকীয় ভাবে মহব্বত নগরে প্রবেশ করে কেন? লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর (PDF)
উত্তর: গ্রামের মানুষ স্বাভাবিকতার চেয়ে চমকপ্রদ আগমন বা নাটকীয়তাকে পছন্দ করে বিধায় মজিদ মহবত নগর গ্রামের যেভাবে প্রবেশ করে, তাতে নাটকীয়তা ছিল।
মজিদের মহব্বতনগরে প্রবেশ হয় নাটকীয়ভাবে। তবে মজিদ ইচ্ছে করেই নাটকীয় করেছে। কারণ গ্রামের লোকেরা ওই ধরনের নাটকীয়তা পছন্দ করে। সরাসরি মতিগঞ্জ এর সড়ক দিয়ে যে গ্রামে এসে ঢুকবে তার চেয়ে বেশি পছন্দ হবে তাকে যে বিলটার বড় অশ্বত্থ গাছের থেকে নেমে আসবে। মজিদ ও চমকপ্রদভাবে এসেছে। তার আগমন মুহূর্তে গ্রামের মানুষকে চমকে দিয়েছে।
৩. তাহেরের বাপ তার মেয়েকে মেরেছে এই কথা শুনে মজিদের মুখ কঠিন হয়ে যায় কেন?
উত্তর: তাহেরের বাপ তার মেয়েকে বেড়েছে এই কথা শুনে ক্রোধে মজিদের মুখ কঠিন হয়ে যায়। লালসালু উপন্যাসের তাহেরের বাপ আর তার বৃদ্ধা মায়ের মধ্যে সব সময় ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকত। একদিন বুড়ি মনের খেদে তার সন্তানদের জন্ম নিয়ে কথা বললে পুরো খেপে গিয়ে বুড়িকে মারতে যায়। কথাটা তার মেয়ে হাসুনির মা মজিদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় এবং তার বিরুদ্ধে সালিশি ডাকে। বৃদ্ধ বুঝতে পারে তার মেয়ের কাজ, কেননা মসজিদের বাড়িতে তারই যাতায়াত আছে। তাই বৃদ্ধ তার মেয়েকে ধরে মারে। তাহেরের বাপ তার মেয়েকে মেরেছে এই কথা শুনে ক্রোধে মজিদের মুখ কঠিন হয়। কারণ এ যেন তার বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ।
৪. “অবশেষে আগ্নেয়গিরির মুখে ছিপি দিয়ে মজিদ সরে যায়” – কথাটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য লেখ। লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর (PDF)
উত্তর: জমিলার প্রতি মজিদের ক্রোধের পূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে না পেরে মজিদ সরে যায়। এখানে সে বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। মহব্বতনগরে কেউ মজিদের হুকুম অমান্য করে না। কিন্তু মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা কিছুটা বিদ্রোহী স্বভাবের। মজিদের আদেশ-নির্দেশ সে খুব একটা মানে না। জমিলা নামায পড়েনি একথা জানার পর মজিদের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। কিন্তু জমিলা তাতে নির্বিকার। মজিদের হঠাৎ মনে হয় জমিলা যেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই সর্তকতা অবলম্বন করে এই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে থেকে সে সরে যায়। যা আলোচ্য অংশে প্রকাশিত হয়েছে।
৫. আমিনা বিবির মনে আশার সঞ্চার হয় কেন?
উত্তর: সন্তান লাভের ক্ষীণ সম্ভাবনা আমেনা বিবি মনে আশার সঞ্চার হয়। সন্তান লাভের তদবির আমেনা বিবি প্রথমে নিরাশ হয়েছিল। কারণ আওয়াল পুরে আগত পীর সাহেবের পানিপড়া সে পায়নি। তাই সে ধরেই নিয়েছিল তার আর সন্তান হবে না। কিন্তু মজিদ যখন পেটের বাড়ির কথা বলে এবং সাতের বেশি বেড়ি না থাকলে তা খোলার ব্যবস্থার কথা জানায়। তখন তার মনে আশার সঞ্চার হয়।
৬. পীরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে মতলুব খাঁ কি বলেছিল?
উত্তর: পীরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে মতলব খাঁ মিথ্যা ও অলৌকিক গুণ বর্ণনা করেছিল। পীরের মুরিদ মতলুব খাঁ পীরের গুণাগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে পীরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা বলেছে। তার মতে পীরসাহেব ইচ্ছে করলে সূর্যকেও এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন। সূর্যকে ধরে রেখে পীর যখন ইচ্ছা জোহরের নামাজ পড়তে পারেন।
৭. “দৃষ্টি বাইরের পানে, মস্ত নদীর ওপারে, জেলার বাইরে-প্রদেশেরও।” – উক্তিটি বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: আলোচ্য উক্তিটিতে শস্যহীন জনবহুল অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়ার ব্যকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। শস্যহীন জনবহুল অঞ্চলটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। কারো ঘরে খাবার নেই। ভাগাভাগি, স্থানবিশেষে খুনাখুনি করে তারা শেষ হয়। জ্বালাময়ী আশা, ঘরে হা শুন্য মুখ থোবড়ানো নিরাশা বলে তাতে মাত্রাতিরিক্ত প্রখরতা। এসব কারণে তারা দূরের টানে বাইরের পানে চেয়ে থাকে।
৮. “মেয়ে লোকের মনের মশকরা সহ্য করবে অতটা দুর্বল নয় সমাজ” – উক্তিটি বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: মহব্বতনগরের সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা যে কতটা নিপীড়িত তা বোঝাতে আলোচ্য উক্তিটি করা হয়েছে। সমাজে যদি কোন মেয়ে আত্মহত্যা করবে বলে একবার ঘোষণা করে, তবে সে মরণের ভয় আবার বিপরীত কথা বলতে পারে না। সমাজে তাকে আত্মহত্যার মালমশলা জুগিয়ে দেয়, সর্বতোভাবে সাহায্য করে যাতে তার ইচ্ছা পূরণ হয়। এই সমাজ ফাঁকি দিয়ে তাকে আর বাঁচতে দেয় না। এই কারণেই প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করা হয়েছে।
৯. সবাই কেন নীরবে মজিদের গালাগালি শুনলো? বুঝিয়ে দাও। লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর (PDF)
উত্তর: মুজিব যখন পীরের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তখন সবাই নামাজরত অবস্থায় ছিল। তাই নামাজ ভেঙ্গে কেউ কথা বলতে না পারায় নীরবে তার গালাগালি শুনলো। আওয়ালপুর গ্রামে পীরের আগমন ঘটলে মজিদ সেখানে যায়। পীরের কর্মকাণ্ড তার মোটেও ভালো লাগে না। সে প্রচন্ড পুড়তে থাকে। কারণ সেখানে কেউ তাকে গ্রাহ্য করেনি। এজন্য সে পীরের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। পীরের অসঙ্গত কার্যকলাপের জন্য পীরকে সে গালাগালি করে। সবাই তখন নামাজরত অবস্থায় থাকায় কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারল না। তাই নীরবে সবাই তার গালাগালি শুনে গেল।
১০. বোন জামাইয়ের ভাত ধলা মিয়ার কাছে মিঠা লাগে কেন?
উত্তর: ধলা মিয়া ভীতু অলস প্রকৃতির মানুষ। সে আত্মনির্ভরশীল নয় বলে বোন জামাইয়ের ভাত তার কাছে মিঠা লাগে। খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বড় ভাইয়ের নাম ধলা মিয়া। বোকা কিসিমের মানুষ সে। পরের বাড়ীতে নির্বিবাদে খায়-দায় ঘুমায় আড়ালে আড়ালে থাকে। খালেক ব্যাপারীর সামনে পড়লে সে সারাক্ষণ পালাই পালাই করে। বোনজামাইয়ের বাড়িতে থাকা খাওয়া তার কাছে বেশি ভালো লাগে। বছরান্তেও নড়ার নাম করে না। উক্ত বক্তব্যে তার কাজের প্রতি নির্লিপ্ত এবং অলসতার কথা বলা হয়েছে।
১১. ‘মনে হয় এটা খোদাতালার বিশেষ দেশ।’-উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: নোয়াখালি অঞ্চলের জনজীবনে অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও ধর্মীয় কাজে কার্পণ্য না থাকায় লেখক ব্যঙ্গ করে আলোচ্য উক্তিটি করেছেন। নোয়াখালি অঞ্চলের মানুষের জীবনে অভাব থাকলেও দেখা যায় ভোরবেলায় মক্তবে কচিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠে আমসিপারা পড়ার কোলাহল। পরনে কাপড় নেই, পেটে ভাত নেই, ল্যাংটা ক্ষুধাতুর ছেলেরা সেই কোলাহলের অংশীদার। তারা জীবনকে যতটা ভালোবাসে মৃত্যুকে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ভয় পায়। তাই লেখক কিছুটা ব্যাঙ্গাত্বক ভাষায় বলেছেন, এটি হয়তো খোদাতালার বিশেষ একটি অঞ্চল যেখানে মানুষ এতটা ধর্ম সংলগ্ন।
১২. মজিদ যে খেলা খেলতে যাচ্ছে তা সাংঘাতিক কেন?
উত্তর: পাছে তার ভ-ামি ধরা পড়ে যায়-এই ভয় ও সন্দেহের জন্যে মজিদ তার খেলাকে সাংঘাতিক বলেছে। মজিদ ঠিকই জানে প্রাণধর্মের যাঁতাকলে পিষ্ট হবে একদিন তার প্রথা-ধর্ম। সকল বাধা ছিঁড়ে একদিন সত্য বেড়িয়ে আসবে। সে বোঝে যেদিন মানুষ সজাগ হবে সেদিন তার মিথ্যা ফাঁদ ভণ্ডামির দিন শেষ হবে; জয় হবে মানবতার সুনিশ্চিত। তাই তিনি যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন অশিক্ষিত, মূর্খ গ্রামবাসীদের নিয়ে সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে খেলায় নেমেছেন, তা বড়ই সাংঘাতিক।
১৩. ‘কিন্তু তারও যে বাঁচবার অধিকার আছে সেই কথাটাই সে সাময়িক চিন্তার মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে।’-ব্যাখ্যা কর। লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর (PDF)
উত্তর: আলোচ্য উক্তিটি দ্বারা মজিদের নিজস্ব ভাবনার একটি দিক উদঘাটিত হয়েছে। মজিদ সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার জন্য মধুপুর ছেড়ে নতুন আশায় মহব্বতনগর গ্রামে এসেছে। তার মূল সিদ্ধান্ত হলো টিকে থাকা ও সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা করা প্রয়োজন, তাই তাকে করতে হবে। ন্যায়-অন্যায়, সুনীতি, দুর্নীতি হলো মানুষেরই সৃষ্টি, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে তারও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই সে মিথ্যা প্রতারণার কথা জেনেও এই কঠিন দুঃসাহসী কাজে নেমে পড়ে।
১৪. ‘মাটি-এ গোস্বা করে’-এ কথার ভাবার্থ কী?
উত্তর: মাটিতে রহীমা শব্দ করে হাঁটার ফলশ্রুতিতে মজিদ এ উক্তিটি করে। মাটিতে তৈরি দেহ একদিন মাটিতে মিশে যাবে। মাটিকে আঘাত করে হাঁটলে মৃত্যুর পর মাটি বদলা নিবে-এমন কুসংস্কার একনও গ্রাম বাংলায় প্রচলিত। মজিদের প্রথমা স্ত্রী রহীমা মাটিতে আওয়াজ করে হাঁটলে তা মজিদের পছন্দ হয় না। তাই মজিদ স্ত্রীকে ধর্মের মোড়কে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য শাসন করেছে, মজিদ চায় রহীমার মনে যেমন স্বামীর ভয় থাকবে, অনুরূপ চলনেও।
১৫. মজিদ রহীমার প্রতি গুরুগম্ভীর হয়ে পড়ে কেন? লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর (PDF)
উত্তর: রহীমাকে মজিদ তার ও মাজারের প্রতি ভয় সঞ্চার ও ধর্মের মোড়কে জড়ানো নিজের কথার মর্ম বোঝানোর জন্য গম্ভীর হয়ে পড়ে। মজিদ মহব্বতনগরে স্থায়ী আসন পাতার পাশাপাশি রহীমা নামের এক যৌবন প্রাপ্ত তরুণীকে বিয়ে করে। কিন্তু সাদা-সিধে রহীমার চালচলন একটু বেসামাল। হাঁটার সময় মাটিতে শব্দ করে হাঁটে যা মজিদের পছন্দ নয়। তাই মজিদ তার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য রহীমার প্রতি গুরুগম্ভীর হয়ে পড়ে।